প্রযুক্তির আধিপত্যে ভুলতে বসেছি যেসব খেলা এক সময় গড়ে তুলত শৈশবের আনন্দ, শারীরিক সক্ষমতা ও সমাজিক বন্ধন।

বাংলার হারিয়ে যাওয়া দেশীয় খেলাধুলা: ঐতিহ্যের স্মৃতিচারণা

বাংলা সংস্কৃতি মানেই যেন এক প্রাণবন্ত ইতিহাস—যার ভাঁজে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য এবং খেলাধুলা। তবে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে বাংলার অনেক ঐতিহ্যবাহী দেশীয় খেলাধুলা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এইসব খেলা এক সময় শুধু শিশু-কিশোরদের জন্য বিনোদনের উৎসই ছিল না, ছিল সামাজিকতা, শৃঙ্খলা ও শারীরিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমও।

 

আজকের প্রজন্মের কাছে যেসব খেলার নামও অপরিচিত, সেগুলো এক সময় ছিল প্রতিদিনকার জীবনের অংশ। গ্রামের মাঠ, খোলা উঠোন কিংবা স্কুল ছুটির পরের সময়টা যেন শুধু খেলাতেই ভরে থাকত।

চলুন, ফিরে দেখি বাংলার সেই হারানো খেলার জগৎ।

গোল্লাছুট

গোল্লাছুট ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় দলভিত্তিক খেলা। দুটি দলের মধ্যে একদল গোলের ভিতরে থাকে, অন্য দল চেষ্টা করে গোল ছুঁয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে। এই খেলায় শুধু দৌড়ানো নয়, বুদ্ধিমত্তা ও দলগত সমন্বয়ও প্রয়োজন হতো। সাহস ও স্পিড ছিল এই খেলায় জয়ের মূল চাবিকাঠি।

দাড়িয়াবান্ধা

দাড়িয়াবান্ধা খেলায় নির্দিষ্টভাবে টানা রেখার উপর দাঁড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়েরা চেষ্টা করত প্রতিপক্ষের চলাচল ঠেকাতে। অপর পক্ষ চেষ্টা করত তাদের গা না লাগিয়ে রেখা পেরিয়ে যেতে। এটি এক প্রকার মানসিক ও শারীরিক কৌশলের খেলা, যা প্রতিযোগিতার স্পৃহা গড়ে তুলত।

বৌছি (কাবাডি)

বৌছি খেলায় একজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের এলাকায় প্রবেশ করে তাদের ছুঁয়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসে, একটানা “বৌছি বৌছি” বলার মাধ্যমে। এটি এখন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পর্যায়ে উন্নীত হলেও এক সময় এটি গ্রামীণ বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে দেখা যেত। খেলাটি সহনশীলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং শারীরিক ফিটনেস উন্নত করত।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ

এই খেলায় একজন খেলোয়াড়ের চোখ বাঁধা থাকে, আর অন্যরা তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। চোখ বাঁধা খেলোয়াড়কে কাউকে ধরতে হয়। এটি শিশুদের মজা, ধৈর্য, এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা বাড়াতে সাহায্য করত।

লাটিম খেলা

লাটিম ঘোরানো ছিল একধরনের দক্ষতার খেলা। কাঠ বা ধাতুর তৈরি লাটিমে দড়ি প্যাঁচিয়ে সেটিকে ঘোরানো এবং নির্দিষ্ট জায়গায় ঘোরাতে পারা ছিল কৌশলের পরিচয়। একে কেন্দ্র করে চলত নানা ধরনের প্রতিযোগিতা, কে কতক্ষণ ঘোরাতে পারে, কে কার লাটিম কেটে দিতে পারে—এসব ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।

নৌকা বাইচ ও হা-ডু-ডু

বাংলার কিছু বিশেষ অঞ্চল, বিশেষ করে নদীপথ অধ্যুষিত এলাকায়, নৌকা বাইচ ছিল গ্রামীন মেলার প্রধান আকর্ষণ। বিশাল লম্বা নৌকায় একসাথে অনেক জন মিলে পাল্লা দিয়ে বৈঠা চালাত।
হা-ডু-ডু ছিল কাবাডির মতোই, তবে কিছুটা বেশি হিংস্র ধরণের খেলা, যেখানে ধাক্কাধাক্কি ছিল অধিক।

এই খেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কেন?

আজকের প্রজন্ম প্রযুক্তির প্রতি এতটাই আসক্ত যে তারা বাস্তব মাঠের বদলে মোবাইল গেম, ভিডিও গেম, কিংবা ভার্চুয়াল জগতে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অন্যদিকে শহুরে এলাকায় খেলার মতো খোলা জায়গা নেই বললেই চলে।
তাছাড়া, অভিভাবকদের মধ্যেও অনেক সময় এই দেশীয় খেলাগুলোর গুরুত্ব বোঝার অভাব দেখা যায়।

উদ্ধার ও পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস

এই খেলাগুলোকে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ—

  • স্কুল পর্যায়ে দেশীয় খেলার প্রতিযোগিতা
  • গ্রাম ও শহরে স্থানীয় টুর্নামেন্ট
  • সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ও তথ্যভিত্তিক কনটেন্ট
  • পরিবারে সন্তানদের এই খেলাগুলোর সাথে পরিচয় করানো

দেশীয় খেলাগুলো শুধু একটি ক্রীড়া অনুশীলন নয়, বরং জাতির সংস্কৃতি ও পরিচয় বহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

বাংলার হারিয়ে যাওয়া দেশীয় খেলাধুলা আমাদের জাতিগত চেতনা, ঐতিহ্য ও সমাজের অংশ। এই খেলাগুলোর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে তৈরি হয় সৌহার্দ্য, শৃঙ্খলা ও সম্মিলিত চেতনা। এখনই সময়—এই ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ফিরিয়ে দেওয়ার, যাতে তারা গর্ব করে বলতে পারে—”এই খেলাগুলো আমাদের ছিল, আছে এবং থাকবে।”

 

Leave a Comment

On a scale of 1-5, how would you rate your experience?